সীরাতুন নবী (সাঃ) - ০২ || প্রাচীন আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ || ইয়ামান সাম্রাজ্য || দ্বিতীয় হিমইয়ারী || হীরাহর সাম্রাজ্য ||
প্রাচীন আরবের বিভিন্ন রাজ্য ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ
এ পর্বের বিষয়সূচীঃ
আরব উপদ্বীপে নাবী সাঃ-এর দাওয়াত প্রকাশের প্রাক্কালে দু’প্রকারের রাজ্য শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
১. মুকুট পরিহিত সম্রাট। তবে তারা প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত ছিলেন না।
২. গোত্রীয় দলনেতাগণ। মুকুট পরিহিত সম্রাটগণের যে মর্যাদা ছিল অন্যান্য খ্যাতিসম্পন্ন গোত্রীয় দলনেতাগণেরও সেই মর্যাদা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ছিল তা হচ্ছে, তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে সকল সাম্রাজ্যে মুকুটধারী সম্রাটগণের প্রশাসন কায়েম ছিল সেগুলো হচ্ছে শাহানে ইয়ামান, শাহানে আলে গাসসান (শামরাজ্য) এবং শাহানে হীরাহ (ইরাক)। অবশিষ্ট অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই ছিল গোত্রীয় দলনেতার প্রশাসন।
ইয়ামান সাম্রাজ্য:
আরবে ‘আরিবার অন্তর্ভুক্ত যে সকল সম্প্রদায় প্রাচীনতম ইয়ামান সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারাই ছিল সাবা সম্প্রদায় ভুক্ত। প্রাচীন ‘উর’ (ইরাক) ভূখন্ডের বহু পুরাতন ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের ধ্বংসস্তুপ থেকে যে সকল তথ্য প্রমাণাদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাতে খ্রীষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বের সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব একাদশ শতকে তাঁদের অভ্যূদয় সূচিত হয়েছিল বলে তথ্য প্রমাণাদিসূত্রে অনুমিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ তথ্যাদির ভিত্তিতে তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যে ধারণা করা হয়ে থাকে তা হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ হতে ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত।
এসময়ে কিছু নির্দিষ্ট দেশসমূহে তাদের রাজত্ব ছিল বলে জানা যায়। যাওফ’এ অর্থাৎ নাযরান ও হাজরামাওত এর মধ্যবর্তী স্থানে তাদের আধিপত্য প্রকাশ পায়। অতঃপর তানমূ অধিকৃত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে প্রশস্ত হয় ও বিস্তার লাভ করে এমন কি তাদের রাজনৈতিক প্রভাব উত্তর হিযাজের ‘মা‘আন ও উ‘লা’ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
কথিত আছে যে, তাদের কলোনী বা উপনিবেশ আরববিশ্বের বাইরেও বিস্তার লাভ করে। ব্যবসায় ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। অতঃপর মায়ারিবের সেই বিখ্যাত বাঁধ নির্মাণ করা হয় যা ইয়ামানের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিল। তাদেরকে পৃথিবীর প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছিল। কুরআনে এসেছে, (حَتّٰى نَسُوْا الذِّكْرَ وَكَانُوْا قَوْمًا بُوْرًا) ‘পরিণামে তারা ভুলে গিয়েছিল (তোমার প্রেরিত) বাণী, যার ফলে তারা পরিণত হল এক ধ্বংশপ্রাপ্ত জাতিতে।’
সেই সময়কালে শাহানে সাবার মর্যাদাসূচক উপাধি ছিল ‘মোকাররবে সাবা’। তাঁর রাজধানী ছিল সিরওয়াহ- যার ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা চিহ্ন আজও মায়ারেব শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ৫০ কিলোমিটার পথের দূরত্বে ও ‘সনয়া’ থেকে ১৪২ কিলোমিটার পূর্বে দেখতে পাওয়া যায় এবং তা খারিবা নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। এ রাজ্য বংশানুক্রমে ২২ থেকে ২৩ জন বাদশা দেশ শাসন করেন।
২. খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ অব্দ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এসময় কালে তাদের রাজত্বকে ‘সাবা সাম্রাজ্য’ বলা হতো। ‘সাবা’ সম্রাটগণ মোকাররব উপাধি পরিত্যাগ করে ‘রাজা’ (বাদশা) সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণ করেন এবং ‘সারওয়াহ’ এর পরিবর্তে মায়ারেবকে সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা দেন। সেই শহরের ধ্বংসস্তুপ আজও ‘সনয়া’ নামক স্থানের ১৯২ কিলোমিটার পূর্বে পরিদৃষ্ট হয়।
৩. খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত।
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘প্রথম হিমইয়ারী’ বলা হয়। কেননা সাবা রাষ্ট্রের উপর ‘হিময়ার’ গোত্র প্রাধান্য লাভ করে ও সাবা রাজ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাদের রাজ্যকে ‘সাবা ও যূ রায়দান’ বলা হয়। আর তারা মায়ারেবের পরিবর্তে ‘রায়দানকে’ রাজধানী করেন। পরে রাজধানীর নাম ‘রায়দান’ পরিবর্তন করে ‘জিফার’ রাখা হয়। এ শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও ‘ইয়ারিম’ শহরের নিকটে এক গোলাকার পর্বতে পরিদৃষ্ট হয়।
এ সময় থেকেই সাবা সম্প্রদায় এর পতন শুরু হয়ে যায়। নাবেতীয়গণ প্রথমে হিজাযের উত্তর প্রদেশে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে সাবা সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপনকারীদের সেখান থেকে বহিস্কার করেন। অধিকন্তু রুমীগণ মিশর, শাম এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়ার ফলে সমুদ্রপথে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ক্বাহত্বানী গোত্র সমূহও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ার ফলে নিজ নিজ আবাস স্থল পরিত্যাগ করে তাঁরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
(৪) ৩০০ খ্রীষ্ট্রাব্দের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত।
দ্বিতীয় হিমইয়ারী
এ সময়ে তাদের রাজত্বকে ‘দ্বিতীয় হিমইয়ারী’ বলা হয় এবং তাদের রাজ্য ‘সাবা, যূ রায়দান, হাজরামাওত ও ইয়ামনত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইয়ামানের মধ্যে অব্যাহতভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা ঘটতে থাকে। একের পর এক বহু বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে এবং এর ফলে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অবাঞ্ছিত সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন কি এ পর্যায়ে এমন এক অবস্থার উদ্ভব হয় যার ফলশ্রুতিতে ইয়ামানের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সেই যুগের রুমীগণ এডেন দ্বীপে সৈন্য সমাবেশ করে তার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর হিময়ার ও হামদানের পারস্পরিক আত্মকলহের সুযোগ নিয়ে হাবশীগণ রুমী গোত্রের সহায়তায় তাঁদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে। হাবশীগণের এ দখলদারিত্ব স্থায়ী থাকে ৩৭৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এর পর ইয়ামানের স্বাধীনতা এক প্রকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। কিন্তু মায়ারিবের মশহুর বাঁধে শুরু হল ফাটল। সেই ফাটল ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পেতে অবশেষে ৪৫০ অথবা ৪৫১ খ্রীষ্টাব্দে বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। এ বাঁধের ভাঙ্গনের ফলে ভয়াবহ প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে যায়, যার উল্লেখ কুরআন শরীফের (সুরা সাবা) সায়লে আরেম নামে উল্লেখিত হয়েছে। এ ভয়াবহ প্লাবনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যায় এবং বহু গোত্র নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে ৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ভিন্ন ধাঁচের এক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ইয়ামানের ইহুদী সম্রাট ‘যূনওয়াস’ নাজরানের খ্রীষ্টানদের উপর এক ন্যাক্কারজনক আক্রমণ পরিচালন করে খ্রীষ্ট ধর্ম পরিত্যাগ করে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাঁদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু খ্রীষ্টানগণ কোনক্রমেই এতে সম্মত না হওয়ায় ‘যূনওয়াস’ কতগুলো গর্ত খনন করে তাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন এবং সেই সকল অগ্নিকুন্ডে খ্রীষ্টানদের নিক্ষেপ করেন। কুরআন শরীফের সূরাহ বূরুজের (قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ) শেষ অবধি আয়াত দ্বারা এ লোমহর্ষক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এ ঘটনার ফল এ দাঁড়ায় যে রুমীয় সম্রাটগণের নেতৃত্বে খ্রীষ্টানগণ আরব উপদ্বীপের শহর ও নগরের উপর বার বার আক্রমণ চালিয়ে বিজয়ী হতে থাকেন। এতে উৎসাহিত হয়ে ইহুদীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাঁরা সংকল্পবদ্ধ হয়ে যান এবং এ প্রতি আক্রমণে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা দানের জন্য হাবশীগণকে সরবরাহ করা হয়। রুমীগণের সহযোগিতা লাভের ফলে হাবশীগণ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন এবং ৫২৫ খ্রীষ্টাব্দে ইরয়াতের নেতৃত্বে ৭০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন এবং পুনরায় ইয়ামানের উপর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। হাবশা সম্রাটের গর্ভনর হিসেবে ইরয়াত ইয়ামানের শাসন কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু আবরাহা বিন সাবাহ আল আশরাম নামে তাঁর অধীনস্থ এক সৈনিক ৫৪৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে হত্যা করে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে হাবশ সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতে সক্ষম হন এবং খুশী করেন। ইনি ছিলেন সেই আবরাহা যিনি ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বিশাল হস্তী বাহিনী সহ ক্বাবা’হ অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষী বাহিনী কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হন। আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে এ ঘটনা ‘আসহাবে ফীল’ (হস্তীবাহিনী) নামে প্রসিদ্ধ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ফীলের ঘটনার পর সনয়া ফিরে আসার পর তাকে ধ্বংশ করেন। তারপর তার পুত্র ইয়াকসূম সিংহাসনে আরোহন করেন। এরপর রাজত্ব করেন দ্বিতীয় পুত্র মাসরূক। তাদের উভয়ের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা ছিল তাদের পিতার থেকেও খারাপ এবং ইয়ামানবাসীকে নিপীড়ন-নির্যাতন ও যুলূম-অত্যাচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্বভাবের।
আসহাবে ফীলের ঘটনার পর ইয়ামানবাসীগণ পারস্যরাজ্যের সাহায্যপুষ্ট হয়। এবং হাবশীগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইয়ামানবাসীগণ সাইফ বিন যূ ইয়াযান হিময়ারীর সন্তান মা’দীকারবের নেতৃত্বে হাবশীগণকে সে দেশ থেকে বহিস্কার করে মুক্ত স্বাধীন সম্প্রদায় হিসেবে মাদী করেককে সম্রাট মনোনীত করেন। এ ছিল ৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা।
স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের পর মা’দীকারাব কিছু সংখ্যক হাবশীকে নিজের খেদমত এবং রাজদরবারের জাঁকজমক বৃদ্ধির কার্যে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ অবিমৃষ্যকারিতা প্রসূত ভ্রান্ত নীতির কারণে ‘দুগ্ধ কলা সহকারে সর্প পালন’ প্রবাদ বাক্যটি এক মর্মান্তিক সত্যে পরিণত হয়ে যায়। প্রতারণা করে ঐ হাবশীগণ একদিন মা’দীকারাবকে হত্যা করার মাধ্যমে যূ ইয়াযান পরিবারের শাসন ক্ষমতাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। আর দেশটি পারস্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এরপর থেকে পারস্য বংশোদ্ভূত কয়েকজন গভর্ণর একাদিক্রমে ইয়ামান প্রদেশের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। অবশেষে সর্বশেষ পার্সী গভর্ণর বাযান ৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করলে ইয়ামান পারস্য শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী জীবনধারা ও শাসন সৌকর্যের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করে।[1]
[1] সৈয়দ সোলাইমান নদভী (রহঃ) ‘তারিখে আবযুল কুরআন’’ ১ম খন্ড ১৩৩ পৃঃ থেকে শেষ পযন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণাদির আলোকে সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিবরণসহ আলোচনা করেছেনত, মওদূদী (রহ.)ও তাফহীমুল কুরআনের চতুর্থ খন্ডে ১৯৫-১৯৮ পৃষ্ঠায় বিবরণাদি একত্রিত করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের উৎস হিসেবে এ সব ক্ষেত্রে বেশ মত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কোন কোন গবেষক বিবরণাদি পূর্ববর্তীগণের কাহিনী বলে বর্ণনা করেছেন। {إِنْ هٰذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ} (٨٣) سورة المؤمنون
হীরাহর সাম্রাজ্য
ইরাক এবং উহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কুরুশকাবির (৫৫৭-৫২৯ খ্রীষ্টাব্দপূর্বাব্দ) এর সময় হতেই পারস্যবাসীগণের শাসন ব্যবস্থা চলে আসছিল। এ সময়ের মধ্যে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি কিংবা সাহস কারোরই ছিল না। তারপর খ্রীষ্টাব্দপূর্ব ৩২৬ অব্দে ইসকান্দার মাক্বদূনী পারস্য রাজ প্রথম দারাকে পরাজিত করে পারস্য শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এর ফলে সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো এবং সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে ২৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ঐ সময় ক্বাহত্বানী গোত্রসমূহ দেশত্যাগ করে ইরাকের এক শস্য-শ্যামল সীমান্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এ দিকে আবার দেশত্যাগী আদনানীগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। তারপর যুদ্ধে জয়লাভ করে তাঁরা ফোরাত নদীর উপকূলভাগের এক অংশে বসতি স্থাপন করেন।
এসব হিজরতকারীদের মধ্যে প্রথম সম্রাট ছিলেন ক্বাহত্বান বংশের মালিক বিন ফাহম তানূখী। তিনি আনবারের অধিবাসী ছিলেন বা আনবারের নিকটবর্তী স্থানে। এক বর্ণনা মতে তারপর তার ভাই ‘আমর বিন ফাহম রাজত্ব করেন। অন্য বর্ণনা মতে জাযীমাহ বিন মালিক বিন ফাহম। তার উপাধি ছিল ‘আবরাশ ও ওয়াযযাহ’।
অন্য দিকে ২২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরদশীর যখন সাসানী সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ধীরে ধীরে পারস্য সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ও ক্ষমতার পুনরুদ্ধার হতে থাকে। আরদশীর পারস্যবাসীকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন এবং দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আরবদের অধীনস্থ করেন। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কুযা’আহ গোত্র শাম রাজ্যের দিকে গমন করেন। পক্ষান্তরে হীরা এবং আনবারের আরব বাসিন্দাগণ বশ্যতা স্বীকারের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেন।
আরদশীর সময়কালে হীরাহ, বাদিয়াতুল ইরাক এবং উপদ্বীপবাসীগণের রাবীয়ী এবং মুযারী গোত্রসমূহের উপর জাযীমাতুল ওয়ায্যাহদের আধিপত্য ছিল। এ থেকে এটাই বুঝা যায় যে, আরববাসীদের উপর আরদশীর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করতে চাননি। তিনি এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আরববাসীগণের উপর সরাসরি আধিপত্য বিস্তার করার কিংবা সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের লুঠতরাজ বন্ধ করা খুব সহজে সম্ভব হবে না। এ প্রেক্ষিতে তিনি একটি বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন এবং তা ছিল, যদি গোত্র থেকে একজন শাসক নিযুক্ত করা হয় তাহলে তাঁর স্বগোত্রীয় লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সাহায্য লাভ সম্ভব হতে পারে।
এর ফলে আরও যে একটি বিশেষ সুবিধা লাভের সম্ভাবনা ছিল তা হল, প্রয়োজনে রুমীয়গণের বিরুদ্ধে তাঁদের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণের সুযোগ থাকবে। অধিকন্তু, শাম রাজ্যের রোম অভিমুখী আরব অধিপতিদের বিরুদ্ধে ঐ সকল আরব অধিপতিদের দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতিকে কিছুটা অনুকূল রাখা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশেষভাবে সময়ের জন্য মৌজুদ রাখা হতো যার দ্বারা মরুভূমিতে বসবাসকারী বিদ্রোহীদের দমন করা সহজসাধ্য হতো।
২৬৮ খ্রীষ্টাব্দের সময় সীমার মধ্যে জাযীমা মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং ‘আমর বিন ‘আদী বিন নাসর লাখমী (২৬৮-২৮৮ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন লাখম গোত্রের প্রথম শাসনকর্তা ও তিনিই সর্বপ্রথম হীরাহকে স্বীয় বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং শাবূর আরদশীর এর সম-সাময়িক। এরপর কুবায বিন ফাইরুযের (৪৪৮-৫৩১ খ্রীষ্টাব্দ) যুগ পর্যন্ত হীরাহর উপর লাখমীদেরই শাসন কায়েম ছিল। কুবাযের সময় মাজদাকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা নরপতি। কুবায এবং তাঁর বহু প্রজা মাজদাকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কুবায আবার হীরাহর সম্রাট মুনযির বিন মাউস সামায়ের (৫১২-৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) নিকট এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন সেই ধর্মগ্রহণ করে নেন। কিন্তু মুনযির ছিলেন যথেষ্ট আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন প্রকৃতির ব্যক্তি। প্রেরিত পয়গামের কোন গুরুত্ব না দিয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফল এটা দাঁড়ায় যে, কুবায তাঁকে তাঁর পদ হতে অপসারণ করে তাঁর স্থানে মাযদাকের এক শিষ্য হারিস বিন ‘আমর বিন হাজর ফিন্দীর হাতে হীরাহর শাসনভার অর্পণ করেন।
কুবাযের পর পারস্যের রাজ্য শাসনভার এসে পড়ে কিসরা আনুশেরওয়ার (৫৩১-৫৭৮ হাতে। ঐ ধর্মের প্রতি তাঁর মনে ছিল প্রবল ঘৃণা। তিনি মাযদাক এবং তাঁর অনুসারীগণের এক বড় দলকে হত্যা করেছিলেন। তারপর পুনরায় মুনযিরের প্রতি হীরাহর শাসনভার অর্পিত হয় এবং হারিস বিন ‘আমরকে তাঁর দরবারে আগমণের জন্য আহবান জানানো হয়। কিন্তু তিনি বনু কালব গোত্রের দিকে পলায়ন করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
মুনযির বিন মাউস সামার পরে নু’মান বিন মুনযিরের (৫৮৩-৬০৫ খ্রীষ্টাব্দ) কাল পর্যন্ত হীরাহর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরই বংশধরের উপর ন্যস্ত করেন। আবার যায়দ বিন আদী ঊবাদী কিসরার নিকট নু’মান বিন মুনযির সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করলে কিসরা রাগান্বিত হয়ে নু’মানকে নিজ দরবারে তলব করেন। নু’মান গোপনে বনু শায়বাহন গোত্রের দলপতি হানী বিন মাসউদের নিকট গিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সহায় সম্পদ তাঁর হেফাজতে দিয়ে কিসরার নিকট যান। কিসরা তাঁকে জেলখানায় আটক করে রাখেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ দিকে কিসরা নু’মানকে কয়েদ খানায় আটকের পর তাঁর স্থানে ইয়াস বিন ক্বাবিসাহ তায়ীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং হানী বিন মাস’ঊদের নিকট থেকে নু’মানের রক্ষিত আমানত তলব করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। কিছুটা সূক্ষ্ণ মর্যাদাসম্পন্ন লোক হানী তলবী আমানত প্রদান করতে শুধু যে অস্বীকারই করলেন তাই নয় বরং যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। তারপর যা হবার তাই হল। ইয়াস নিজের সুসজ্জিত বাহিনী, কিসরার বাহিনী এবং মুরযবানের পুরো বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন মোকাবিলা করার জন্য। ‘যূ ক্বার’’ নামক ময়দানে উভয় দলের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বনু শায়বাহন বিজয়ী হন এবং পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। ইতিহাসে এ যুদ্ধ অতীব গুরত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আজমীদের বিরুদ্ধে আরবীদের এটাই ছিল প্রথম বিজয়। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নাবী কারীম (ﷺ)-এর জন্মের পর।
ইতিহাসবিদগণ এ যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর জন্মের অল্প কিছুকাল পর। অথচ হীরাহর উপর ইয়াসের আধিপত্য লাভের অষ্টম মাসে নাবী কারীম (ﷺ) দুনিয়াতে তশরীফ আনয়ন করেন। আবার কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পূর্বে। এটাই সঠিকতার নিকটবর্তী। কেউ বলেছেন, নবুওয়াতের কিছুকাল পর। কেউ বলেছেন, হিজরতের পর। কেউ বলেছেন, বদর যুদ্ধের পর ইত্যাদি।
ইয়াসের পর কিসরা এক পার্সীকে হীরাহর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার নাম আযাদবাহ বিন মাহিব্ইয়ান বিন মিহরাবান্দাদ। তিনি ১৭ বছর (৬১৪-৬৩১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) শাসন করেন। কিন্তু ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে লাখমীদের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুনযির বিন নু‘মান মা’রুব নামক এ গোত্রের এক ব্যক্তি শাসন কাজ পরিচালনে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনের সময়ানুক্রমে যখন সবেমাত্র অষ্টম মাস অতিক্রান্ত হয়েছিল এমতাবস্থায় তখন ইসলামের বিশ্ববিশ্রুত বীর কেশরী সিপাহ সালার খালিদ বিন ওয়ালীদ ইসলামের উপচে পড়া প্রবহমান প্লাবনধারার অগ্রদূত হিসেবে হীরায় প্রবেশ করেন।
শাম রাজ্যের শাসন
যে যুগ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে সেই যুগে এক স্থান থেকে স্থানান্তরের হিজরত করে যাওয়ার এক হিড়িক সৃষ্টি হয়েছিল আরব গোত্র সমূহের মধ্যে। কুযা’আহ গোত্রের কয়েকটি শাখা শাম রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন সেখানে। বনু সুলাইম বিন হুলওয়ানদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল। বনু যাজ’আম বিন সুলাইম নামক যে গোত্রটি যাজা’য়িমাহ নামে পরবর্তী কালে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল তা ছিল ওদের অন্তর্ভুক্ত। কুযা’আহর সেই শাখাকে রুমীগণ আরব মরুভূমিতে যাযাবরগণ কর্তৃক পরিচালিত লুটতরাজের কবল থেকে নিস্কৃতি লাভ ও লুটতরাজ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এবং পার্সীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের পৃষ্ঠপোষক বানিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে তাঁদেরই এক ব্যক্তির মাথায় রাজ্য শাসনের মুকুট পরিধান করিয়েছিল।
এরপর থেকে বেশ কিছু কাল যাবৎ তাঁরই পরিচালনাধীন রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালিত হতে থাকে। এদের মধ্যে সব চাইতে প্রসিদ্ধ শাসক ছিলেন সম্রাট যিয়াদ বিন হাবুলাহ। অনুমান করা হয় যে যাজায়েমাহ গোত্র কর্তৃক পরিচালিত রাজ্য শাসন ব্যবস্থা দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের পুরোটা জুড়েই চলছিল। তারপর সেই অঞ্চলে গাসসানী গোত্রের বংশধরগণের আগমনের কথাবার্তা চলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে এটা বলাই বাহুল্য যে ইতোমধ্যেই গাসসানীগণ বনু যাজাআমাকে পরাজিত করে তাঁদের ক্ষমতা ও সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রুমীগণ গাসসানী বংশের শাসককে শাম অঞ্চলের জন্য আরবীয়দের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। গাসসানীদের রাজধানী ছিল ‘বসরা’। রুমীয় কর্মকান্ডের পরিচালক হিসেবে শাম অঞ্চলে পর্যায় ক্রমে সে পর্যন্ত তাঁদেরই রাজত্ব চলতে থাকে, যে পর্যন্ত ফারুকী প্রতিনিধিত্ব কালের মধ্যে ১৩ হিজরীতে ইয়ারমুক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং গাসসানী বংশের শেষ শাসক জাবলা বিন আইহাম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন[1]। (যদিও তার অহংবোধ ইসলামী সাম্যকে বেশী সময় পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে সে স্বধর্ম ত্যাগী হয়ে যায়।)
[1] মুহাযারাতে খুযরী, ১ম খন্ড ৩৪ পৃঃ তারীখে আরযুল কুরআন ২য় খন্ড ৮০-৮২ পৃঃ।
কৃতজ্ঞতাঃ
আর-রাহীকুল মাখতূম (মোহরাঙ্কিত জান্নাতী সুধা)
প্রকাশনায়- তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা
******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url