জীবন ঘনিষ্ট ইসলামিক প্রশ্নোত্তর (পর্ব -০৬) || কৃত্রিমভাবে সন্তান নেওয়া || কন্যা সন্তান হলে স্ত্রীকে দোষ দেয়া || স্বামী তার স্ত্রীকে মা বললে ||
কৃত্রিমভাবে সন্তান নেওয়া
কৃত্রিমভাবে সন্তান নেওয়ার বিধান কি?
কৃত্রিম উপায়ে সন্তান প্রজনন মূলতঃ দুইভাবে হয়ে থাকেঃ
(ক) অভ্যান্তরিক প্রজনন। আর তা এভাবে হয় যে, পুরুষের বীর্য সিরিঞ্জের সাহায্যে নারীর গর্ভাশয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে রাখা হয়।
(খ) বাহ্যিক প্রজনন। আর তা এইভাবে হয় যে, নারী পুরুষের বীর্য নির্দিষ্ট টেস্ট টিউবে নিয়ে মিলন ঘটানোর পর যথাসময়ে নারীর গর্ভাশয়ে রাখা হয়।
উক্ত দুই পদ্ধতির প্রজনন অনুসারে ছয় ভাবে সন্তান নেওয়া হয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়তে তার কিছু বৈধ, কিছু অবৈধ।
প্রথমতঃ অভ্যান্তরিক প্রজননঃ
১। সঙ্গমের সময় স্বামীর বীর্য স্ত্রীর গর্ভাশয়ে কারণবশতঃ না পৌছলে তা নিয়ে সিরিঞ্জের সাহায্যে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া।
২। স্বামীর বীর্যে শুক্রকীট না থাকলে অন্য কোন পুরুষের বীর্য নিয়ে সিরিঞ্জের সাহায্যে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া।
দ্বিতীয়তঃ বাহ্যিক প্রজননঃ
৩। স্বামী স্ত্রীর বীর্য নিয়ে টেস্ট টিউবে রেখে মিলন ঘটিয়ে যথাসময়ে তা স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া।
৪। স্ত্রীর গর্ভাশয় সুস্থ, কিন্তু ডিম্বাণু না থাকার ফলে স্বামীর বীর্য এবং অন্য কোন মহিলার ডিম্বাণু নিয়ে প্রজনন টেস্ট টিউবে মিলন ঘটিয়ে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া।
৫। স্বামীর বীর্যে শুক্রকীট না থাকলে এবং স্ত্রীর গর্ভাশয় সুস্থ, কিন্তু তার ডিম্বাণু না থাকার ফলে অন্য পুরুষের বীর্য এবং কোন মহিলার ডিম্বাণু নিয়ে প্রজনন টেস্ট টিউবে মিলন ঘটিয়ে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া।
৬। স্ত্রীর গর্ভাশয় সন্তান ধারনে অক্ষম হলে অথবা গর্ভ ধারণের কষ্ট বরণ না করতে চাইলে স্বামী স্ত্রীর বীর্য নিয়ে টেস্ট টিউবে রেখে মিলন ঘটিয়ে যথা সময়ে তা অন্য কোন মহিলার গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সন্তান নেওয়া যায়।
সরাসরি ব্যভিচার ছাড়া উক্ত ছয় উপায়ে সন্তান গ্রহণ প্রচলিত রয়েছে বিশ্বের বহু দেশে এবং সে জন্য বীর্য ব্যাংকও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এই শ্রেণীর সন্তান নেওয়ার বিধান নিম্নরূপঃ
কেবল বিলাসিতার জন্য কৃত্রিম পদ্ধতিতে সন্তান নেওয়া ইসলামে বৈধ হতে পারে না। কারণ, পর্যাপ্ত কারণ ব্যতিরেকে স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের নিকট স্ত্রীর লজ্জাস্থান প্রকাশ করা বৈধ নয়। তাছাড়া চিকিৎসার জন্য প্রথমতঃ মুসলিম মহিলা ডাক্তারের সাহায্য গ্রহণ করা ওয়াজেব। তা না পাওয়া গেলে অমুসলিম মহিলা ডাক্তার। তা না পাওয়া গেলে অমুসলিম ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করানো বৈধ। তাতেও কোন পুরুষ ডাক্তারের সাথে কোন রুমে একাকিনী চিকিৎসা করানো বৈধ নয়। জরুরী হলে, সেই রুমে তার স্বামী অথবা অন্য মহিলা থাকবে।
বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের উদ্দেশ্যে মুসলিম মহিলার ডাক্তারের কাছে যাওয়া বৈধ। তবে সন্তান গ্রহণের ছয়টি পদ্ধতির মধ্যে কেবল প্রথম ও তৃতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা বৈধ। আর উক্ত উভয় পদ্ধতিতে যে সন্তান হবে, তা হবে বৈধও সন্তান।
পরিশেষে সতর্কতার বিষয় এই যে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া যেন মুসলিম উক্ত দুটি বৈধ পদ্ধতিও অবলম্বন না করে, কারণ তাতেও টেস্ট টিউবের মাধ্যমে অজ্ঞাত পরিচয় শুক্রাণুর অনুপ্রবেশ ঘটার আশঙ্কা থাকে। ৫৮৫ (মাজলিসুল মাজমাইল ফিকহী)
কন্যা সন্তান হলে স্ত্রীকে দোষ দেয়া
অনেক পুরুষ আছে, যাঁদের কন্যা সন্তান হলে স্ত্রীকে দোষ দেয়, তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় হলে তো রেহাই নেই। এমন পুরুষদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান কি?
নিঃসন্দেহে এমন আচরণ বর্তমানের পণ ও যৌতূক প্রথার করাল গ্রাসের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় দুর্বল ঈমানের মানুষ দ্বারা ঘটে থাকে। আর যে স্বামী কন্য প্রসব করার জন্য স্ত্রীকে দায়ী করে, তার জ্ঞানও দুর্বল। কারণ, বীজ তো তারই। জমির দোষ কি? তাছাড়া কন্যা তার জন্য ভালো হবে না মন্দ, তাই বা সে জানল কি করে? সমাজে দেখা যায় যে, কত কন্যার পিতামাতা সুখী এবং কত পুত্রের পিতা মাতা চিরদুঃখী। তাহলে আল্লাহ্র উপর ভরসা রেখে তার দেওয়া ভাগ ও ভাগ্য নিয়ে কি সন্তষ্ট হওয়া উচিৎ নয়?
পরন্ত কন্যা সন্তান অপছন্দ করা জাহেলী যুগের আচরণ। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“তাকে সে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্নগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুতে দেবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে, তা কতই না নিকৃষ্ট।” (নাহলঃ ৫৯)
মাহরামের সাথে ব্যাভিচার
কোন লম্পট যদি শালী বা শাশুড়ির সাথে অথবা পুত্রবধূর সাথে ব্যভিচার করে, তাহলে তার বিবাহিতা স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে কি?
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন মাহরামের সাথে ব্যাভিচার করা সবচেয়ে বড় ব্যাভিচার। কিন্তু কোন অবৈধ সম্পর্ক বৈধ সম্পর্ককে ছিন্ন করতে পারে না। অবৈধভাবে মিলন ঘটালেই সে তার স্ত্রী হয়ে যায় না এবং তার মা বা মেয়ে স্ত্রীর বন্ধন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্মুক্ত হয়ে যায় না।
মহান আল্লাহ কাকে কাকে বিবাহ হারাম--- সে কথা বলার পর বলেছেন,
“উল্লেখিত নারীগণ ব্যতীত আর সকলকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হল; এই শর্তে যে, তোমরা তাঁদেরকে নিজ সম্পদের বিনিময়ে বিবাহের মাধ্যমে গ্রহণ করবে, অবৈধ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে নয়।” (নিসাঃ ২৪)
যেখানে বৈধ মিলনের ফলে অনেক মহিলা হারাম হওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অবৈধ মিলন ব্যভিচার এর ফলে কেউ হারাম হবে কি না, সে কথা বলেননি। সুতরাং বুঝা যায় যে, উক্ত মহিলাগন ছাড়া অন্য কেউ হারাম নয়। হাদিসে কিছু মহিলার হারাম হওয়ার কথা বলা হলেও ব্যাভিচারের ফলে হারাম হওয়ার কথা বলা হয়নি। অথচ জাহেলি যুগে ব্যভিচারের প্রকোপ খুব বেশী ছিল। সুতরাং বুঝা যায় যে, কোন অপবিত্র সম্পর্ক কোন পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনকে ধ্বংস করতে পারে না। ৫৮৬ (দ্রঃ ৭/৯০, আযওয়াউল বায়ান ৬/৩৪১, মুমতে ৫/২০৩)
স্বামী তার স্ত্রীকে মা বললে
একজন স্বামী তার স্ত্রীকে মা বলে ‘যিহার’ করেছে। অতঃপর তাকে তালাক দিয়েছে। তাকে কি ‘যিহারের’ কাফফারা আদায় করতে হবে?
তালাক দেওয়ার পর যিহারের কাফফারা আদায় করতে হবে না। যেহেতু সে তার স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
“যারা নিজেদের স্ত্রীর সাথে যিহার করে এবং পরে তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তাহলে (এর প্রায়শ্চিত্ত)একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসের মুক্তিদান। এর দ্বারা তোমাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন।” (মুজাদালাহঃ ৩)
সুতরাং স্ত্রীকে স্পর্শ না করতে হলে, কাফফারা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
কোন হতভাগা স্বামী স্ত্রীকে ‘তুই আমার মা বা মায়ের মত’ বললে ‘যিহার’ হয়। কিন্তু যদি কোন হতভাগী স্ত্রী ‘তুমি আমার বাপ বা বাপের মত’ বলে। তাহলে তার বিধান কি?
এ ক্ষেত্রে মহিলার পক্ষ থেকে যিহার হবে না। কেবল মহিলাকে কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে। ৫৮৭ (ইবনে বায)
স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী আল্লাহ্র পানাহ চাইলে
যদি কোন স্ত্রী তার স্বামীকে বলে, ‘আমি তোমার নিকট থেকে আল্লাহ্র পানাহ চাচ্ছি’ তাহলে কি তাকে স্ত্রী রূপে রাখা যাবে?
স্ত্রী যদি স্বামী থেকে আল্লাহ্র পানাহ চাইলে আল্লাহর নামের তা’যীম করে তাকে তা দেওয়া ওয়াজেব। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “কেউ আল্লহর আশ্রয় প্রার্থনা করলে, তাকে আশ্রয় দাও। আর যে আল্লাহ্র নামে যাঞ্চা করবে, তাকে দান কর।”(আবূ দাঊদ, নাসাঈ) তার এক স্ত্রী তার নিকট আল্লাহ্র পানাহ চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি বিশাল সত্তার পানাহ চেয়েছ। সুতরাং তুমি তোমার মায়ের বাড়ী চলে যাও।’ ৫৮৮ (বুখারী ৫২৫৪ নং)
কখন তালাক নেওয়া বৈধ
স্বামীর নিকট থেকে কখন তালাক নেওয়া বৈধ এবং কখন ওয়াজেব?
যখন স্বামী এমন কাজ করবে, যা কবীরা গোনাহ এবং তা কুফরী নয়, বুঝানোর পরও মানতে চাইবে না, তখন তালাক নেওয়া বৈধ। যেমন ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি। কিন্তু সে কাজ করার ফলে মানুষ ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়, তার সাথে সংসার করা বৈধ নয়। তউবা না করলে সে ক্ষত্রে তালাক নেওয়া ওয়াজেব। যেমন মাযার যাওয়া, শিরক করা, দ্বীন, আল্লাহ বা তার রাসুলকে গালি দেওয়া, নামায ত্যাগ করা ইত্যাদি। ৫৮৯ (ইবনে উষাইমীন)
তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে কেন
তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে দেওয়া হল কেন? স্ত্রী তালাক নিতে পারে দিতে পারেনা কেন?
যেহেতু পুরুষ মহিলার তুলনায় জ্ঞানে পাকা, ক্রোধের সময় বেশী ধৈর্যশীল। নচেৎ স্ত্রীর হাতেও তালাক থাকলে সামান্য ঝামেলাতেই সে ‘তোমাকে তালাক’ বলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে থাকত। যেমন অনেক মহিলা সামান্য কিছু হলেই রেগে বলে বসে, ‘আমাকে তালাক দাও’, ‘আমি তোমার ভাত খাব না’ ইত্যাদি।
স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগেই তালাক
বিয়ে পড়ানোর পর স্বামী স্ত্রীর দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই যদি স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে স্ত্রী কি মোহর পাওয়ার অধিকার রাখে?
মোহর বাধা হলে অর্ধেক মোহর পাবে। বাধা না হলে কিছু খরচ পত্র পাবে। আর তার কোন ইদ্দত নেই। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“ যদি স্পর্শ করবার পূর্বে স্ত্রীদের তালাক দাও, অথচ মোহর পূর্বেই ধার্য করে থাক, তাহলে নির্দিষ্ট মোহরের অর্ধেক আদায় করতে হবে। কিন্তু যদি স্ত্রী অথবা যার হাতে বিবাহ বন্ধন, সে যদি মাফ করে দেয়, (তাহলে আলাদা কথা।) অবশ্য তোমাদের মাফ করে দেওয়াই আত্নসংযমের নিকটতর। তোমরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি (ও মর্যাদার) কথা বিস্মৃত হয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সাম্যক দ্রষ্টা। (বাকারাহঃ ২৩৭)”
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বিশ্বাসী রমণীদেরকে বিবাহ করার পর ওদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিলে তোমাদের জন্য তাদের কোন পালনীয় ইদ্দত নেই। সুতরাং তোমরা ওদেরকে কিছু সামগ্রী প্রদান কর এবং সৌজন্যের সাথে ওদেরকে বিদায় কর।” (আহযাবঃ ৪৯)
স্ত্রীকে তালাকের হুমকি
কোন স্বামী যদি স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তুমি অমুকের বাড়ী গেলে তোমাকে তালাক।’ অতঃপর স্ত্রী তা অমান্য করে অমুকের বাড়ী চলে গেলে তালাক হয়ে যাবে কি?
তালাক নির্ভর করছে স্বামীর নিয়তের উপর। স্বামীর উদ্দেশ্যে যদি সত্যই তালাক দেওয়ার থাকে, তাহলে তালাক হয়ে যাবে। তালাকের নিয়ত না থাকলে এবং স্ত্রী যাতে অমুকের বাড়ী না যায়, সে ব্যপারে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে থাকলে তালাক হবে না। তবে সে ক্ষেত্রে কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে। ৫৯০ (ইবনে জিবরীন)
****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url