অধঃপতনের মূল কারণ | লোভ-লালসা | লোভের পরিণতি সম্পর্কে একটি গল্প


লোভ-লালসার পরিণতি


অধপতনের মূল কারণ-


লোভ মানুষের অধপতনের অন্যতম কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। যেহেতু লোভ একটি নৈতিক ত্রুটি, তাই বর্তমানে এই বিষয়টি উপর আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন, আর তাই এখানে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল। লোভ মানুষের জীবন থেকে সুখ কেড়ে নেয়। আল্লাহ তায়ালা যে সকল নেয়ামত তাকে দান করেছেন তার শুকরিয়া কখনই সে আদায় তো করেই না, বরং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তার চেয়ে সে বেশী চায় এবং যদি সেটা পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে সে আবার নতুন করে আর একটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেয়। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ব্যক্তি একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে, যদি সে লোভী হয় এবং আল্লাহর শুকুর গোযার না হয় সবসময় তার এই চিন্তা থাকে যে, আরো উন্নত একটি বাড়ি ভাড়া নিতে হবে। যখন পূর্বের চেয়ে আরো উন্নত বাড়ি সে ভাড়া নিতে সক্ষম হয়, তখন সে আবার নতুন করে অন্যের সম্পত্তির প্রতি দৃষ্টি দেয় যে, এবার যদি অমুকের মত একটি সুন্দর বাড়ি বানাতে পারতাম। এভাবেই চলতে থাকে তার লোভের চক্র। আর কখনই সে এ সমস্ত নেয়ামত যা আল্লাহ্ তাকে দিয়েছে তার শুকুর আদায় করে না।


কিন্তু আল্লাহ্‌র মু'মিন বান্দারা যে সকল নেয়ামত তাদেরকে দান করা হয়েছে সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ও তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। আর যদি পরবর্তীতে কিছু তার সম্পদ বৃদ্ধি পায় তবে তার জন্য সে আল্লাহর দরবারে পূর্বাপেক্ষা অধিক শুকরিয়া আদায় করে। আর ভূলেও সে অন্যের সম্পদের প্রতি দৃষ্টি দেয় না। মু'মিনদের এ দলটি সর্বদাই সুখে ও শান্তিতে বসবাস করে। কেননা তারা শুধুমাত্র আল্লাহর নৈকট্য বৈ আর কিছু চায় না।


অসংখ্য রেওয়ায়েত লোভের নিন্দায় বর্ণিত হয়েছে। যার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হল।


قال الإمام الصادق (ع) : حُرِمَ الحريص خصلين و لزمتهُ خصلتان: حُرِمَ القناعةَ فافتقدَ الرّاحة وَ حُرِمَ الرِّضا فافتقدَ اليقين.


লোভের ক্ষতিঃ


ইমাম সাদিক (আঃ) বলেছেন : ‘লোভী দু'টি উৎকৃষ্ট গুণ হতে বঞ্চিত, ফলশ্রুতিতে সে দু'টি দোষের অধিকারী; সে পরিতৃপ্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত ফলে প্রশান্তিকে হাতছাড়া করেছে, [আর] সন্তুষ্টি হতে বঞ্চিত ফলে বিশ্বাসকে খুইয়েছে'।


قال الإمام علی (ع(: أغنی الأغنياءِ مَن لَم يَکُن لِلحرصِ أسيراً.


ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন : ‘সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা ধনি যে লোভের বন্দি নয়'।


الإمام الصادق (ع) : کانَ أميرُ المؤمِنِين صلواتُ الله عليه يقول: ابن آدم، إن کُنت تُرِيدُ مِن الدّنيا ما يَکفِيک فإِنَّ أيسر ما فِيها يَکفِيک، وَ إِن کنت إنّما تُرِيدُ ما لا يَکفِيک فإنَّ کلَّ ما فِيها لا يَکفِيک.


ইমাম সাদিক (আঃ) বলেছেন : আমিরুল মু'মিনীন (আঃ) বলতেন যে, হে আদমের সন্তানেরা! যদি তুমি দুনিয়া হতে পরিমাণ মত চাও তাহলে সেটাই তোমার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি পরিমাণের চেয়ে বেশী চাও, সমস্ত দুনিয়াও তোমার জন্য যথেষ্ঠ নয়'। (আল কাফী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩১৬, হাদীস নং ৭)


লোভের উত্পত্তি কোথা থেকে এর সংজ্ঞা স্বয়ং মহানবী (স.) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল (স.) হতে বর্ণিত ঐ হাদীসটি নিম্নে উল্লেখ করা হল :


قال رسول الله (ص) : اعلم يا علی، أنَّ الجُبنَ و البخلَ و الحِرصَ غَريزةٌ واحِدةٌ، يَجمَعُها سوءُ الظَّنِّ.


রাসুল (সঃ) বলেছেন : ‘হে আলী জেনে রাখ! ভয়, কৃপণতা ও লোভ একই প্রকারের, আর তাদের মূলে হল খারাপ ধারণা পোষন করা'। (এলালুশ শারায়ে, মুন্তাখাবে মিযানুল হিকমাহ, পৃষ্ঠা ১৪৪, হাদীস নং ১৫০৫)


একটি শিক্ষনীয় গল্প

লোভের পরিণাম

বৃথাই লোভ করে মানুষ। লোভের পরিণাম যে কতমারাত্নক ও ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা হয়রত ঈসা (আঃ) একটা চমক প্রদ ঘটনার মাধ্যমে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।

একদিন একজন ইহুদী এসে হয়রত ঈসা (আঃ) এর কাছে এসে আরজ করলো, “হুযুর, আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। আপনার সংসর্গ আমার খুব ভালো লাগে। ”শুনে হয়রত ঈসা (আঃ) তাকে সঙ্গী করে নিলেন।

তারা চলতে চলতে একটি ছোট্ট শহরের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছালেন। হয়রত ঈসা (আঃ) এর সঙ্গে তিনখানা রুটি ছিল। দুজনই ক্ষুধার্ত। তৃপ্তির সঙ্গে তারা দুটো রুটি খেলেন। তৃতীয়টি ইহুদী লোকটির কাছে রেখে হয়রত ঈসা (আঃ) কিছু সময়ের জন্য অন্যত্র গেলেন। ফিরে এসে তিনি রুটি খানার খোঁজ করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “রুটিখানা কোথায়?” উত্তরে ইহুদী চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব এনে বলল, “আমিরুটি খাইনি। আমি আপনার রুটি সম্পর্কে কোন খবর জানি না।” ঈসা (আঃ) আর কোন কিছু না বলে ইহুদীকে সঙ্গে করে চলতে লাগলেন। সামনে এক নির্জন বন। বনের গাছ পালায় ঢাকা পথ ধরে চলছেন দুজন। হয়রত ঈসা (আঃ) হঠাত দেখলেন, একটা হরিনী দুটো শাবক নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ঈসা (আঃ) একটা ছানাকে তার কাছে ডাকলেন। ছানাটি আল্লাহর নবীর ডাক শুনে তার কাছে ছুটে এলো। তিনি শাবকটিকে ধরে ফেললেন এবং আল্লাহর নামে জবাই করলেন। অতপর আল্লাহর অপার মহিমায় শাবকটি তৎক্ষণাত ভাজা হয়ে হেল। তারা দুজন পেট ভরে হরিণের কচি গোশত গেলেন। খেয়ে খুব তৃপ্ত ইহুদীটা।

এবার হয়রত ঈসা (আঃ) বললেন, “হে হরিণ শাবক! জীবিত হয়ে যাও তুমি।” তৎক্ষণাত ওটা জিন্দা হয়ে তার মায়ের কাছে ফিরে গেল। ব্যাপারটা দেখে ইহুদীটা একটুও বিস্মিত হলো না। ঈসা (আঃ) এমন মুজিযা তার কঠিন মনকে নরম করতে পারলো না।

পথ চলতে চলতে ঈসা (আঃ) ইহুদীটার হাত ধরে বললেন, “তোমাকে আল্লাহর কসম। আমার এ অলৌকিক কাজ দেখার পরও কি তোমার মনে আল্লাহর ভয় আসছে না? সত্যি করে বলো, তৃতীয় রুটিখানার কি হয়েছে?” কিন্তু ঊত্তরে পাষাণ হৃদয় ইহুদী বলল, “আমি আপনার রুটির কথা কিছুই জানি না।“ ঈসা (আঃ) তাকে আর কিছু না জিজ্ঞেস করে আবার পথ চলতে লাগলেন।

তারা বন পেরিয়ে একটি বালুকাময় প্রান্তরে পৌঁছালেন। আল্লাহর নবী কিছু বালু একত্র করে একটা স্তূপ বানিয়ে বললেন, “হে বালুকারাশি। আল্লাহর হুকুমে সোনা হয়ে যাও।” সঙ্গে সঙ্গে বালুর ঢিবি সোনায় রুপান্তরিত হয়ে গেল। এবার আল্লাহর নবী পিন্ডটাকে ভেঙ্গে তিন ভাগ করলেন এবং বললেন, “হে ইহুদী! এ তিনটি পিন্ডের একটা পিন্ড আমার, একটা তোমার আর তৃতীয় পিন্ডটা তার, যে রুটি খেয়ে ফেলেছে।”

সোনার লোভে ইহুদী চোখ চকচক করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পোটলা থেকে তৃতীয় রুটিখানা বের করে বললো, “এই যে আপনার আপনার রুটি। এটা এতক্ষণ আমার কাছেই ছিল।” সোনার লোভে ইহুদী সত্য কথা বলে। তখন ঈসা (আঃ)বললেন, “তুমি যখন সত্যকথা স্বীকার করেছ, তিনটা পিন্ডই তোমার।” একথা বলে ঈসা (আঃ) ওকে ছেড়ে অন্য পথে চলে গেলেন।

সোনার তিনটি পিন্ড নিয়ে কিছু পথ চলার পর হঠাত করে ইহুদীর সামনে দুজন দুর্ধর্ষ ডাকাত হাজির হলো। ডাকাতদের দেখেই ইহুদী ভয়ে কাঁপতে লাগলো। সে তাদের বললো, “আমাকে প্রাণে মেরো না। তিনটি খন্ড তো আছেই। কেননা আমরা একজন এক এক খন্ড করে নিয়ে যাই।” ডাকু তাকে হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “সে কথা পরে হবে। বেশ খিদে পেয়েছে। আগে তুই আমাদের জন্য খাবার কিনে আন।”

মনে মনে ডাকাতরা ফন্ধি আটলো যে, ইহুদীটা খাবার নিয়ে এলেই তাকে খতম করে ফেলা হবে। না হলে সে আবার সোনার ভাগ চাইবে। অন্যদিকে ইহুদীটাও ফন্ধি আটলো। সে খাবার কিনে তাতে বিষ মিষিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর যেই ইহুদীটা খাবার নিয়ে এলো ডাকাতরা তার কাছ থেকে খাবার গুলো নিয়ে তাকে হত্যা করলো।

এতপর তারা খাবার গুলো খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর তারা বিষে ছট ফট করতে লাগলো এবং মুখে ফেনা তুলে তারা দুজনই মারা গেল। তিনটি লাশ পড়ে রইলো তিনটি সোনার পিন্ডের পাশে কিন্তু হাত বাড়িয়ে নেয়ার কেঊ নেই। অতি লোভের পরিণাম যে কি ভয়াবহ তা আল্লাহ ঈসা (আঃ) এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন।

★★সমাপ্ত★★

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url